মূল লেখাটি প্রথম আলো থেকে নেওয়া । আপনি মূল লেখাটি এখান থেকে পড়তে পারেন ।
আমি সব সময় বিশ্বাস করি, যদি দেখেন আপনার সামনে এগোনোর পথ তৈরিই আছে,
তার মানে আপনি দেরি
করে ফেলেছেন। উদ্যোক্তাদের কাজই হলো নতুন পথ আবিষ্কার করা। যদি সবকিছু
আমার হাতের কাছেই থাকত, তাহলে হয়তো আলিবাবার জন্ম হতো না। আমার কাছে টাকা ছিল
না, বিশ্ববিদ্যালয়ে
তিনবার অকৃতকার্য হয়েছি, মা-বাবা খুব দরিদ্র ছিলেন,
মোটকথা সামনে কোনো
সুযোগ ছিল না। আফ্রিকার অবস্থাও একই রকম।
১৯৯৪ সালে যখন আমি ব্যবসা শুরু করি, তখন অনেকেই বলেছিল, জ্যাক মিথ্যা কথা বলছে। ইন্টারনেট বলে
কিছু নেই। আমি আমার প্রতিষ্ঠানের নাম নিবন্ধন করতে গেছি। সেখানকার কর্মকর্তারা
বললেন, তুমি কী
ধরনের প্রতিষ্ঠান চালু করতে চাও? আমি বললাম, হানজো ইন্টারনেট কনসাল্টিং কোম্পানি।
তাঁরা বললেন, ইন্টারনেট? আমাদের অভিধানে এ রকম কোনো শব্দ নেই।
তাঁরা আমার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত
যখন আমি আমার প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করলাম, চীনে তখনো ইন্টারনেট ছিল না। আমার
প্রতিষ্ঠান চালু করার তিন মাস পর চীনে ইন্টারনেট এল।
আমি মিথ্যা কথা বলিনি, সেটা প্রমাণ করার জন্য টেলিভিশনের লোকজনকে
আমার বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। মনে আছে, ব্রাউজারে প্রথম পৃষ্ঠাটা ডাউনলোড
হতেই সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছিল। সত্যি! তখন কেউ ইন্টারনেট বিশ্বাস
করত না, ই-কমার্স
বিশ্বাস করত না। কেউ ভাবতেও পারেনি, চীনে ই-কমার্স সম্ভব। কোনো কারিগরি সহায়তা ছিল না,
ক্রেডিট কার্ড ছিল
না।
এখন আফ্রিকাও একই রকম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। কীভাবে তোমরা ই-কমার্স
চালু করবে? তোমাদের তো ক্রেডিট কার্ড নেই, কারিগরি সহায়তা নেই, সরকারের উদ্যোগ নেই,
তোমাদের তো কিছুই
নেই। আমি বলি, এটাই তো সুযোগ! উদ্যোক্তা হিসেবে আমরা কখনো অভিযোগ করতে
পারি না। অভিযোগ তো লোকে করবে, আমাদের প্রতিযোগীরা করবে।
আফ্রিকার তরুণদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য
দিচ্ছেন জ্যাক মাআমার অ্যাপার্টমেন্টে যখন ১৭ জন সহযোগী নিয়ে যাত্রা
শুরু করলাম, আমাদের লক্ষ্য ছিল অনেক বড়। বলেছিলাম, আমরা পৃথিবীর সেরা
১০টা ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বা ওয়েবসাইটের মধ্যে অন্যতম
হব। বলেছিলাম, আমাদের প্রতিষ্ঠান অন্তত ১০২ বছর টিকবে। অথচ তখনো জানতাম না,
পরের মাসের বেতন
কোথা থেকে দেব। চোখে স্বপ্ন থাকলে নিজেকে কখনো দরিদ্র মনে হয় না।
আমরা বলিনি, কাল আমরা জিতব। বলিনি আগামী বছরের মধ্যে আমরা সফল
হব। বলেছিলাম, আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাব।
আলিবাবা প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর পেরিয়েছে। হ্যাঁ, এখন আমরা বিশ্বের সেরা ১০টি
ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি। ১৯ বছর আগে কেউ ভাবতেও পারেনি,
চীনের একটা
প্রতিষ্ঠান বিশ্বের সেরা ১০ প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের একটি
হতে পারে। আপনাদেরও বিশ্বাস করতে হবে, আগামী ১০ বা ২০ বছর পর আফ্রিকায় ১০ থেকে
২০টি আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠান হবে। আপনারা যদি স্বপ্ন না দেখেন, কাজ শুরু না করেন,
তাহলে কখনোই এটা সম্ভব
হবে না।
আফ্রিকার বিপুল জনসংখ্যার অধিকাংশই তরুণ। আমার বন্ধু ড. কাটোয়ি
বলেন, প্রায় ১
কোটি ৩০ লাখ তরুণ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে চাকরি
খুঁজছেন। এই তরুণেরাই তো আপনাদের সম্পদ। আলিবাবা যখন লোক নিয়োগ দেওয়া শুরু
করেছিল, কেউ
আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে চাইতেন না। বলতেন, আলিবাবা—এ আবার কেমন
নাম! তার ওপর অফিসটা একটা অ্যাপার্টমেন্টে। ই-কমার্স ও
ইন্টারনেট কেউ বিশ্বাস করত না। অতএব হাঁটতে পারার যোগ্যতা থাকলেই আমরা যে
কাউকে নিয়োগ দিতে প্রস্তুত ছিলাম! ব্যাপারটা এমন, তোমার স্নাতক বা
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে কি না, তাতে কিছু আসে যায় না, তুমি আমাদের কথা বিশ্বাস
করলেই হলো! আমরা শূন্য থেকে শুরু করেছি। প্রথম ১০ বছর খুব কঠিন সময় গেছে।
কারণ আমরা গ্রাহক পাইনি, ভালো প্রকৌশলী পাইনি, ব্যাংকের সহায়তা পাইনি। অতএব
পাই পাই করে খরচের হিসাব রাখতে হয়েছে।
২০০৭ সালে হংকংয়ে আলিবাবা যখন প্রথম আইপিওতে গেল, অনেক মিলিয়নিয়ারের
সঙ্গে আমাদের পরিচয় হলো। আমি আমার সেসব বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, তুমিই কেন
মিলিয়নিয়ার হলে? তুমি বাকিদের চেয়ে বুদ্ধিমান বলে? তারা বলল, ‘না না! আমরা তো একটা চাকরির যোগ্যও হয়ে
উঠতে পারিনি।’ বললাম, তোমরা কি পরিশ্রমী? তারা বলল, ‘হ্যাঁ। তবে আমরা আমাদের চেয়েও পরিশ্রমী লোকজনকে
আমাদের দলে নিয়েছি।’ সেই ‘আরও পরিশ্রমী’ মানুষগুলোও কিন্তু মিলিয়নিয়ার হননি। আমরা
স্রেফ নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছি, নিজের স্বপ্নের ওপর বিশ্বাস রেখেছি,
একসঙ্গে কাজ করেছি।
আমরা এই জায়গায় পৌঁছেছি, কারণ কেউ আমাদের চায়নি।
আমি সেই লোক, যাকে ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রত্যাখ্যাত
হওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবার কাছ থেকে ‘না’ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে
পড়েছিলাম।
মানুষ কেন আপনাকে সাহায্য করবে? মানুষ আপনাকে সাহায্য করলে সেটা
অস্বাভাবিক। কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। সাহায্যটা আপনাকে
অর্জন করে নিতে হবে। আলিবাবার আরও ১৭ জন সহপ্রতিষ্ঠাতাকে অনুপ্রাণিত করতে আমি
কিছু কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, আমাদের প্রতিযোগীরা খুব শক্তিশালী। সে সময়
আমাদের প্রতিযোগী ছিল ইবে। ইবে-তে এমন অনেক লোক কাজ করতেন, যাঁরা হার্ভার্ড
থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। আমরা কোথা থেকে পাস করেছি? নাম বললে চিনতে
পারবেন না, অতএব আমি বলতেও চাই না। তো আমি বলেছিলাম, আমরা যদি সফল হতে পারি, তাহলে চীনের ৮০
শতাংশ তরুণই সফল হতে পারবেন।
অনেকের স্বপ্ন আছে, কিন্তু তাঁরা পরিশ্রম করেন না। অনেকে পরিশ্রম
করেন, কিন্তু
তাঁদের কোনো স্বপ্ন নেই। উদ্যোক্তাদের মধ্যে দুই-ই থাকা চাই। স্বপ্ন
দেখতে হবে, পরিশ্রমও করতে হবে। তাহলেই আমরা জয় পাব।
ওই সব বিশেষজ্ঞের কথা শুনবেন না, যাঁরা বলবেন এটা কোরো না, ওটা কোরো না।
আপনাদের চোখ তো ভবিষ্যতের দিকে। ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারবে, পৃথিবীতে এমন কোনো
বিশেষজ্ঞ নেই। আমরা উদ্যোক্তারাই একদিন বিশেষজ্ঞ হব। একজন
উদ্যোক্তাকে ব্যর্থতার সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হয়। আপনারা বলেন, আলিবাবা একটা সফল
প্রতিষ্ঠান। আমরা কিন্তু বলি না। আলিবাবা শুরু হয়েছে ১৯৯৯ সালে। ১০২ বছর
টিকে থাকার প্রত্যয় নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম। মাত্র ১৯ বছর
পেরিয়েছি। আরও তো ৮৩ বছর বাকি। আমরা কখনোই বলি না, আমরা সফল। বরং বলি, আমরা মাত্র ১৯টা বছর পার করেছি। আমরা সৌভাগ্যবান।
গত ১৯ বছরে আমরা কিন্তু হাজারো ভুলও করেছি। উদ্যোক্তা হিসেবে
অন্যের
সাফল্য থেকে শিখবেন না। বরং তাঁদের ব্যর্থতা থেকে শিখুন।
এমবিএ পড়তে গেলে তারা আপনাকে অনেক সাফল্যের গল্প পড়াবে। এত এত
সাফল্যের গল্প পড়েই বুঝি আপনিও সফল হয়ে যাবেন? না। এমন অনেক কিছু আছে, যা আপনি জানেন না।
ভুল থেকে শিখুন। যত প্রতিষ্ঠানে আমি গিয়েছি, দেখেছি অধিকাংশ
প্রতিষ্ঠানের ভুলগুলো একই। কিন্তু আপনি যদি সাফল্যের কারণ খোঁজেন, দেখবেন একেকজনের
সাফল্যের পেছনের কারণ একেক রকম। আমি বলছি না, ভুলগুলো সম্পর্কে জানলে আপনি
ভুল করবেন না। বরং আপনি জানবেন, কীভাবে এই ভুলগুলোর মোকাবিলা করতে হয়।
একজন উদ্যোক্তা এক দিকে যেমন কঠিন হৃদয়ে তাঁর ভুল, সমস্যা, কঠিন সময়ের মোকাবিলা
করবেন; অন্যদিকে
তাঁকেই কোমল হৃদয়ে সহকর্মী ও গ্রাহকদের সামনে দাঁড়াতে হবে। একটা
মূল্যবোধের জায়গায় আলিবাবা অনন্য। আমি মনে করি, সারা বিশ্বেরই এই মূল্যবোধটা অনুসরণ করা
উচিত। আমাদের কাছে গ্রাহকের অগ্রাধিকার সবার ওপরে। তারপর কর্মী,
তারপর ব্যবসায়িক
ভাগীদার। অনেকেই কিন্তু ব্যবসায়িক ভাগীদারদের সবচেয়ে বেশি
গুরুত্ব দেয়। মনে রাখবেন, গ্রাহকেরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি তাঁদের
ভালো সেবা দিতে পারেন, তাঁরা আপনাকে টাকা দেবেন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিষ্ঠানের
কর্মী। কেন? কারণ, কর্মীরাই তো গ্রাহককে সেবা দেবেন! যদি গ্রাহক
খুশি থাকেন, কর্মীরা খুশি থাকেন, তাহলে ব্যবসায়িক ভাগীদারেরাও খুশি থাকবেন।
দ্বিতীয় আরেকটা মূল্যবোধ আমাদের আছে। সেটা হলো, আমরা সব সময় পরিবর্তনকে
স্বাগত জানাই। পরিবর্তনের মধ্যে থাকাই হলো টিকে থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়।
আমরা কখনো আমাদের স্বপ্নটা বদলাইনি। বরং নিজেকে বদলেছি। অতএব আফ্রিকার
উদ্যোক্তাদের আমি বলব, শুধু নিজের দেশের কথা ভাববেন না। শুধু আফ্রিকার কথা ভাববেন
না। পুরো বিশ্বকে নিয়ে ভাবুন। নিজের দেশ নিয়ে ভাবা আর শুধু নিজের গ্রাম
নিয়ে ভাবা একই কথা। ইন্টারনেট পুরো বিশ্বটাকে সংযুক্ত করেছে। সুযোগটা কাজে
লাগান।
এই মহাদেশের মানুষ খুব সহজ-সরল। যদি ইউরোপে যান, দেখবেন মানুষগুলো
ভীষণ জটিল। তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, এটা, সেটা...নানা কিছু! ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শুরু
করার আগেই তারা একগাদা নিয়মকানুন দাঁড় করিয়ে ফেলে। কিন্তু এখানে?
আপনাদের তো হারানোর
কিছু নেই। এ কথা মনে রাখবেন। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মো.
সাইফুল্লাহ
No comments:
Post a Comment