মূল্যস্ফীতিঃ
মূল্যস্ফীতি বলতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন দেশের দ্রব্য বা সেবার মূল্যের স্থায়ী একটা উর্ধগতি বুঝায়। সাধারণভাবেই মানুষ নিত্যদিন যে দ্রব্যের প্রয়োজন বোধ করে তার দাম নিয়েই তার চিন্তা থাকে। আর তাই মূল্যস্ফীতি মানে অর্থনীতির সব দ্রব্যের দামের পরিবর্তনকেই বুঝায় না বরং জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের একটি ‘বাস্কেট’ বা গুচ্ছের(বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র ২৬৪ টার মত পণ্যের একটা বাস্কেট আছে) গড় দাম একটি নির্দিষ্ট সময়ে কতটুকু পরিবর্তিত হল তাই নির্দেশ করে।
এই সময় হতে পারে, প্রতিদিনকার ভিত্তিতে, মাসিক ভিত্তিতে, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কিংবা ষাম্মাষিক বার্ষিক ও পয়েন্ট টু পয়েন্ট সময়ের ভিত্তিতে।
মূল্যস্ফীতির প্রভাবঃ
- মূল্যস্ফীতির প্রথম প্রভাবই হল মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। অর্থাৎ একই পরিমাণ টাকা খরচ করে আপনি এখন পূর্বের চেয়ে কম দ্রব্য পাবেন।
- মূল্যস্ফীতি সঞ্চয় প্রবণতা পরিবর্তন করে দেয়। মূল্যস্ফীতিতে যেহেতু টাকার ক্রমক্ষমতা কমে যায় তাই ভবিষ্যতে আরো কমে যাওয়ার আশংকায় মানুষের মাঝে সঞ্চয় না করে খরচ বাড়িয়ে দেবার প্রবণতা দেখা যায়।
- মূল্যস্ফীতি বৈদেশিক বাজারে দেশীয় পণ্যের প্রতিযোগিতার শক্তি কমিয়ে দিতে পারে। কারণ মূল্যস্তীতি বাড়লে মজুরী ও বেতন বাড়াতে হয়। আর মজুরি বাড়লে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় আবার মধ্যমেয়াদে সুদের হার বেড়ে যায় এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
আরো জানতেঃ
মুদ্রাস্ফীতিঃ
মুদ্রাস্ফীতি বলতে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়। অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটে। কারণ অনেক বেশি টাকা সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে ধাওয়া করে। এতে চাহিদা ও মূল্যস্তর—দুটিই বেড়ে যায়। শাস্ত্রীয় ও আভিধানিক অর্থেও মুদ্রাস্ফীতির অর্থ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে, যাতে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়।
অর্থনীতিবিদ কেমারার (Kemmerer) এর মতে ‘‘যখন দেশে মোট মুদ্রার যোগান চাহিদার তুলনায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি করে তখন মুদ্রাস্ফীতি ঘটে’’।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে যে সব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তাকে মোটামুটি তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে
যথাঃ (ক) আর্থিক ব্যবস্থা,
(খ) রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থা
(গ) অন্যান্য ব্যবস্থা।
ক) আর্থিক ব্যবস্থাঃ মুদ্রাস্ফীতির প্রধান করাণই হল অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। সুতরাং মুদ্রাস্ফীতি দুর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমাতে হবে। এ অর্থের পরিমান কমাতে হলে ব্যাংক আৃণের পরিমানও কমাতে হবে। কারণ বর্তমান অর্থ ব্যবস্থায় ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের সাহায্যে বহু লেনদে হয়ে থাকে। এ ঋণের পরিমাণ কমাতে পারলে মোট প্রচলিত অর্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রত্যেক দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে তার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো প্রধানঃ
(১) ব্যাংক হার বৃদ্ধিঃ কেন্দ্রী ব্যাংক যে হারে বাণিজ্যিক ব্যাংককে টাকা ধার দেয় তাকে ব্যাংক হার বলা হয়। কেন্দ্রী ব্যাংক এ ব্যাংক হার বাড়ালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও তাদের সুদের হার সাধারণত বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ ব্যসাধ্য হয়ে পড়ে এবং ঋণের পরিমাও স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এভাবে মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রী ব্যাংক ব্যাংক হার বাড়িয়ে দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে।
(২) খোলাবাজারী কারবারঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় খোলা বাজারে সরকারী ঋণপত্র বিক্রয় করে ব্যাংক সৃষ্ট অর্থের পরিমাণ কমাতে চেষ্টা করে। এরূপভাবে ঋণপত্র বিক্রয় করলে ক্রেতাগণ তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর চেক কেটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাওনা মিটিয়ে থাকে। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যায় । এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খোলাবাজারে ঋণপত্র বিক্রয় করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের রিজার্ভের হার পরিবর্তন, নৈতিক চাপ প্রয়োগ, প্রত্যক্ষ ঋণ নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির সাহায্যে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে মুদ্রাস্ফীতি দুর করার চেষ্ট করে।
খ) রাজস্ব সঙক্রান্ত ব্যবস্থাঃ বর্তমানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক ব্যবস্থা অপেক্ষা ফিসক্যাল বা সরকারী আয় -ব্যয় সংক্রান্ত নীতি অনেক বেশি কার্যকরী। মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ হল অতিরিক্ত ব্যয়। কাজেই অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমান কমাতে পারলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সরকার যদি আয় ব্যয় নীতি এমনভাবে প্রচরন করেন যাতে মোট ব্যয়ের পরিমান কমে যায় তা হলে মুদ্রাস্ফীতির চাপও কমে যাবে। রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যবস্থার মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো প্রধান-
(১) সরকারী ব্যয় হ্রাসঃ সরকারী ব্যয় দেশের মোট ব্যয়ের পরিমানের একটা মোটা অংশ। কাজেই মুদ্রাস্ফীতির সময় সরকারী ব্যয় কমানো উচিত। সরকারী খাতে যথাসম্ভব অনাবশ্যক ব্যয় বন্ধ করা উচিত।
(২) অতিরিক্ত কর ধার্যঃ মুদ্রাস্ফীতি নিরোধের আর একটা প্রকৃত উপায় হল করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। বেশি করে কর দিতে হলে জনসাধারণের হাতে ব্যয়যোগ্য আয় কমে যায়। কাজেই মোট ব্যয়ের পরিমান কমে যায় । নতুন নতুন কর ধার্য করে এবং পুরাতন করের হার বাড়িয়ে লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমানো যেতে পারে।
(৩) সরকারী কর্তৃক ঋণ গ্রহণঃ মুদ্রাস্ফীতি নিরোধের জন্য সরকারী জনসাধারণের নিকট হতে অধি পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে থাকে। এতে জনসাধারণের উদ্বৃত্ত আয় সরকারের হস্তগত হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়।
(৪) সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদানঃ সরকার জনসাধারণকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করেও মোট ব্যয়ের পরিমান হ্রাস করতে পারে।ভ সুদের হার বাড়িয়ে দিলে জনসাধারণ অধিক পরিমাণে সঞ্চয়ে আগ্রহান্বিত হবে। এর ফলে ব্যয়ের পরিমান কমে যাবে।
গ) অন্যান্য ব্যবস্থাঃ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক ব্যবস্থা ও রাজস্ব ব্যবস্থাদি ছা[ড়াও কতগুলো ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এগুলোকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ বলা হয়।
(১) উৎপাদন বৃদ্ধিঃ মুদ্রাস্ফীতির সময় দ্রব্যের উৎপাদন যথাসম্ভব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। দেশের অব্যবহৃত সম্পদগুলোকে ব্যবহার দ্রব্যের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। দেশের উৎপাদনশীল সম্পদকে অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন হতে সরিয়ে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে।
(২) আমদানী বৃদ্ধিঃ মুদ্রাস্ফীতির সময় আমদানির পরিমাণ বাড়ালে বাজারে দ্রব্যের যোগান বাড়বে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমে যাবে।
(৩) মজুরি নিয়ন্ত্রণঃ মুদ্রাস্ফীতির সময় শ্রমিকগণ মজুরির হার বাড়ানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তাদের অধিক মজুরি দেয়ার ফলে উৎপাদন ব্যয় এবং মুল্যস্তর বেড়ে যায়। তখন শ্রমিকেরা পুনরায় মজুরী বৃদ্ধির দাবি করে। এভাবে ক্রমাগতভাবে মুল্যস্তর ও মজুরি বৃদ্ধি পেতে থাকে । সেইজন্য অনেক সময় আইন করে বা আপোসের মাধ্যমে মজুরি বৃদ্ধি বন্ধ রাখা হয়।
(৪) মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থাঃ অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশনিং ব্যবস্থা চালূ করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কিছুটা কমানো যেতে পারে।
(৫) মুদ্রা অবৈধকরণঃ মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করলে অনেক সময় পুরাতন মুদ্রা পরিত্যাগ করে নতুন মুদ্রার প্রচলন হয়। কোন কোন সময় বেশি মূল্যের নোটকে অচল করে দেয়া হয়।
(৬) গচ্ছিত অর্থ আটকঃ মুদ্রাস্ফীতির সময় জনসাধারণ বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিরা যাতে বেশি অর্থ ব্যয় করতে না পারে সেজন্য অনেক সময় সরকার তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের সম্পূর্ণ বা কিছু অংশ সাময়িকভাবে আটক করে রাখে। এর ফলে এ অংশ ব্যয় করা সম্ভবপর হয় না। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমে।
মুদ্রাস্ফীতি নিঃসন্দেহে একটা জটিল ও গুরুতর সমস্যা। কোন একটা বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে তা দুর করা সম্ভব নয়। এজন্য উপরোক্ত পদ্ধতির সাহায্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আরো জানতেঃ
No comments:
Post a Comment