১৮ বছর বয়সে শিক্ষানবিশ হিসেবে জেনারেল মোটরসে কাজ শুরু করেছিলেন ম্যারি বারা। আজ তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। ২০১৬ সালের ১১ জুন নিজ ক্যাম্পাসেই তিনি গিয়েছিলেন সমাবর্তন বক্তা হয়ে লেখাটি প্রথম আলো থেকে কালেক্ট করে রাখা আপনি মুল পোষ্ট এখান থেকে পড়ুন |
অভিনন্দন স্নাতকেরা! মনে হচ্ছে প্রায় এক জীবন আগে আমি তোমাদের আসনে বসে ছিলাম। সমাবর্তনের রোমাঞ্চ আমার মনে আছে। তোমাদের দেখে আজ আবার সেই রোমাঞ্চ অনুভব করছি।
যত দূর জানি, তোমরা স্ট্যানফোর্ডের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাচ। তোমাদের ক্লাসে শতকরা ৪২ ভাগ নারী। শতকরা ৪৪ ভাগ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী। এমনকি তোমাদের ক্লাসে বিশ্বের ৬২টি দেশের প্রতিনিধি আছে। গতকাল নাশতার টেবিলে তোমাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। এই আলাপে যা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তা হলো ভাবনার বৈচিত্র্য।
আমি যখন স্নাতক করেছি, পৃথিবীটা সে সময়ের তুলনায় এখন অনেক বদলে গেছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হয়েছিল ১৯৯০ সালে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব’ বলে একটা চমকপ্রদ জিনিসের সঙ্গে তখন মাত্রই পরিচয় হয়েছে। স্মার্টফোন, এসএমএস বলে কিছু ছিল না। মুঠোফোন যখন এল, সেটা শুধু কথা বলার কাজেই ব্যবহার হতো। তবে সবকিছু বদলে যায়নি। স্ট্যানফোর্ড এখনো বিশ্বের অন্যতম সেরা স্কুল। এ কথা আমি জানি, কারণ তোমাদের যে শিক্ষকেরা পড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আমারও শিক্ষক ছিলেন। আমি জানি, যে নতুন পথ তোমাদের সামনে অপেক্ষা করছে, তোমরা তার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এই পথ একদিন আমিও পেরিয়ে এসেছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তোমাদের যাত্রা কেবল শুরু।
স্ট্যানফোর্ডে এসেই প্রথম জেনেছিলাম, আমি কী জানি না, আমি আসলে সেটাই জানি না। বয়স ছিল ২৬। সাউথ ইস্ট মিশিগানে বড় হয়েছি। ১৮ বছর বয়স থেকে জেনারেল মোটরসে কাজ করেছি। স্ট্যানফোর্ডে এসে আমি নতুন করে সবকিছু দেখতে শিখলাম। ক্যাম্পাস আমার জীবন বদলে দিল। ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের কৌশল শিখলাম। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেতৃত্ববিষয়ক ৪টি শিক্ষা আজ তোমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেব। এই শিক্ষাগুলো আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আশা করি তোমাদের জন্যও হবে।
প্রথমত, নেতৃত্ব দিতে হলে অন্যের কথা শুনতে হয়। তুমি যদি কিছু না জানো, সেটা মেনে নিতে তো সমস্যা নেই। সাহায্য চাওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। তুমি যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছ, তাদের কথা তোমাকে শুনতে হবে। তোমার চারপাশে এমন মানুষ থাকা উচিত, যারা তোমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। তুমি যখন ভুল করবে, তারা তোমার ভুল ধরিয়ে দেবে। তুমি যখন একটা বড় পদে চলে যাবে, জেনারেল ম্যানেজার কিংবা প্রধান নির্বাহী হবে, তখনো কিন্তু অন্যের কথা শোনার প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে না; বরং বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব দিতে হলে তোমাকে অন্যের দেখভাল করতে হবে। আশির দশকের শেষ দিকে আমি এখানে পড়ালেখা করেছি। তখন এমবিএ ডিগ্রিধারীদের ১৯৮৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ওয়াল স্ট্রিটছবির গর্ডন গেকো চরিত্রটির সঙ্গে তুলনা করা হতো। মাইকেল ডগলাস এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। গর্ডন গেকোর মন্ত্র ছিল সহজ: লোভ থাকা ভালো।
আজকের পৃথিবীতে অনেকেই ব্যবসায়ীদের অবজ্ঞা করে। গ্যালাপের একটি সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করে না। তুমি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকার, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান কিংবা দাতব্য সংস্থা, যেখানেই নেতৃত্ব দাও না কেন, সমাজে তোমার প্রতিষ্ঠানের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার দায়িত্ব তোমার। সমাজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। জেনারেল মোটরসে আমার দায়িত্ব যেমন গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। ব্যবসায় তুমি যত ভালোই করো না কেন, যতক্ষণ না তোমার কাস্টমার তোমাকে জয়ী হিসেবে স্বীকৃতি দেবে, ততক্ষণ তুমি জয়ী নও।
তৃতীয় শিক্ষাটি হলো, একজন নেতা সব সময় অনুপ্রাণিত করে। প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে কাস্টমারের সন্তুষ্টির ওপর। এটা যেমন সত্যি, তেমনি কর্মীদের সন্তুষ্টিও খুব জরুরি। আমার বিশ্বাস, একটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে এই দুটো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে সমন্বয় করতে পারে। এটাই একজন নেতার দায়িত্ব। এমন একটা কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেন কর্মীরা তাঁদের সবটুকু ঢেলে দিয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য অবদান রাখতে পারেন। দিন শেষে মানুষগুলোই প্রতিষ্ঠান। ভেতরের এবং বাইরের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্কই একটা ব্যবসায় সাফল্য এনে দিতে পারে। এটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কর্মীদের কাছে দায়বদ্ধ থাকি। আমরা কী করছি আর কী করতে যাচ্ছি, সে সম্পর্কে তাঁদের পরিষ্কারভাবে বলি। তাঁদের অনুপ্রাণিত করি যেন তাঁরা নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন।
চতুর্থ শিক্ষা, নেতা হতে হলে কাজ করতে হয়। শুধু মেধা থাকলে হয় না। কারণ পরিশ্রম দিয়ে একজন মেধাবীকে হারানো যায়, কিন্তু মেধা দিয়ে একজন পরিশ্রমীকে হারানো যায় না।
আমি মাঝেমধ্যে আমার মা-বাবার কথা ভাবি। খুব হতাশার মধ্য দিয়ে তাঁরা বড় হয়েছেন। মা নর্দার্ন মিশিগানে একটা ফার্মে থাকতেন। বাবা বেড়ে উঠেছেন মিনেসোটার একটা ধাতব খনির এলাকায়। তাঁরা তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি। দুজনেরই স্রেফ হাইস্কুলের ডিগ্রি ছিল। কিন্তু তাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন, আর স্বপ্নপূরণের জন্য পরিশ্রম করেছেন। আমাকে আর আমার ভাইকে শিখিয়েছেন, পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। আগে কাজ, তারপর খেলা। তাঁরা শুধু একটা পরিবার গড়েননি, একটা বিশ্বাসের ভিত গড়েছেন। সেই বিশ্বাসের ওপর আমরা বেড়ে উঠেছি।
শিক্ষা তোমার সামনে দরজা খুলে দেবে। মেধা তোমার সামনে দরজা খুলে দেবে। কিন্তু তোমাকে কল্পনার চেয়েও বেশি সাফল্য এনে দেবে তোমার পরিশ্রম।
x
No comments:
Post a Comment